সুষম রহস্য উদঘাটন প্রকল্প || পর্ব-০৩
বালুর উপর দৌড়ানোর সময় আমরার পায়ে দাগ হাওয়ার পরে আবার তা মুইচ্চেয়া (মুছে) যায়!
শানু জবাব দিল-হুম। দেখলাম তো।
শহর আলী আবার প্রশ্ন করল-এইডারে কি বলে জানস নি?
-মনে নাইরে শহুর আলী। পড়েছিলাম বোধহয়।
-এইডারে কয় ‘সারফেইস টেনশন’, মানে উপড়ি পাতন। ফিজিক্স ক্লাসে স্যারে কইছিন না? ভুলে গেছছনি?
-হুম তাইতো! মনে পড়েছে এখন। তাইতো! যাহ। তোরে মাফ করে দিলাম। জ্ঞানের কথা কইছছ বলে আর কিছু বললাম না। সবাই আবার একসাথে হাততালি দিয়ে গুলশান আর শহুর আলীর এই কথোপকথনের দৃশ্যটুকু উদযাপন করল।
অভুক্ত সবাই। মাঝে মাঝে হাঁটার গতি কমে আসে। সবাই জিরিয়ে নেয় কোন এক গাছের ছায়ায়। পাখির কিচির-মিচির আর ছায়া সুনীবিড় গ্রামগুলি যেন তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অজানা এক স্বপ্নের দেশে। দীর্ঘ রেখার মতো আবর্তিত গ্রামীণ মেঠো পথে কিছুদূর পর পর গরুর গাড়ির দেখা মেলে। সেগুলোতে সোয়ারীরা বসে থাকে। গর্তে পরে যাওয়া কোন এক গরুর গাড়ির চাকা ঠেলে তুলে দেয়ার বিনিময়ে সেটায় চড়ার একটা সুযোগ পেল তারা। 'গুরুত- গারুত' আওয়াজ তুলে ঘুরতে লাগল গরুর গাড়ির চাকাযুগল। মাঝে মাঝে গতি বৃদ্ধির জন্য সবাই মিলে লাঠি দিয়ে গরুর পেছনের দিকটায় গুঁতো দেয়।
তখন গরুগুলোও একটু দ্রুত চলে। হঠাৎ গতি বৃদ্ধির ফলে গরুর গাড়ি ঝাঁকি মারে। তখন সবাই 'হই' বলে চিৎকার দেয়। কাছে ও দূরে বিস্তৃত ধানের ক্ষেতে বাতাসের আলতু ধাক্কায় দুলতে থাকে ধানের শীষগুলো। সবাই দু'চোখ ভরে গ্রাম বাংলার অবারিত সৌন্দর্য হরণ করতে থাকে৷ সকলের খিদে বাড়ছে তো বাড়ছেই। এক সময় মনে হয় এই খিদে সহ্য হচ্ছে না কারোই। সবাই তখন ভাবতে লাগল যে আফরোজার বিয়েতে হয়তো মুরগি -পোলাও খেয়ে সেই খিদে নিবারণ করবে। মাংস খাওয়ার পর ডাল খাবে। সবশেষে দই বা ফিন্নি জাতীয় কিছু একটা হয়তো দেবে। হাত ধুয়ে সবাই পান খাবে। কাঠি দিয়ে দাঁত খিলাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথা ভাবছে আর সবাই মুখ দিয়ে লালা ঝরাচ্ছে। গুলশানের কাছেও বর্তমানে আফরোজাকে হারানোর কষ্টের চেয়ে খিদের কষ্টটাই মূখ্য মনে হচ্ছে। সে বিড় বিড় করে বলতে লাগল-
খুদার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
খিদের ঠেলায় সবাই গরুর গাড়ি থেকে এক লাফ দিয়ে নেমে গেল। মনে হচ্ছে খিদের জ্বালায় সকালেরই মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু একটা খেতে হবে। মেঠো পথের দু'ধারে শুধু দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের খেত আর খেত।অসম্ভব সুন্দর সবুজের সমারোহ। হঠাৎ শহুর আলী সবাইকে ইশারায় দূরে কিছু একটা দেখাল। কয়েকটা ছাগল রাস্তা ধরে ঘাস খাচ্ছে। তাদের অবস্থান থেকে সামান্য দূরে। দুলাল বলল- অহন খাসি জবাই কইরা খায়াম নাকি? ফাগল কোহানকার! শহুর আলী মাথায় না করল। নিঃশব্দে সে তার জিহ্বাটা লম্বা করে বের করে দুলাতে দুলাতে হাত দু'টো সামান্য উপরে তুলে আঙ্গুলের মাথাগুলো গুচ্ছ করে উপর থেকে নীচে কিছু একটা টেনে নামানোর ইশারা দিতে লাগল।
গুলশান খেয়াল করল একটা ছাগলের দুধের ওলানগুলো বেশ মোটা তাজা আর নাদুষ নুদুষ। শহুর আলী বোধহয় ছাগলের দুধই পান করার ইশারা দিচ্ছে। সবাই বিষয়টা মুহূর্তের মধ্যেই টের পেল। সমস্বরে 'না না' বলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠল। সাথে সাথে শহুর আলীরও যুক্তি আরম্ভ হলো-
- ক্যান মরুভূমিতে ক্লান্ত হইয়্যা সাহাবীগণ মেষের দুধ পান করে নাই? আমরা অহন বিপদে আছি। আফরোজাগো বাড়ি যদি না ফাই ( পাই), তাইলে তো না খাইয়্যা ফেরত যাওন লাগবো। মহাত্মা গান্ধী সব সময় নিজের সাথে ছাগল রাখত কেড়ে জানিস?
আলমাস --- হু জানি।
শহুর আলী --- ক দেহি কেন রাখতো?
আলমাস --- উনি সব সময় হাঁটতেন আর ছাগলের দুধ খেতেন। কারণ ছাগলের দুধ খেলে নাকি পায়ের জোর বেশি হয়। তবে দুধ অবশ্যই আগুনে জ্বাল দিয়ে খেতেন। অহন তুইতো দেহি আমরারে কাছা ( কাঁচা) দুধ খাওয়াইবি।
গুলশান --- একটা কাহিনি তো তোরা মনে হয় জানস না।মহাত্মা গান্ধী যে বছর আমাদের এই পূর্ববাংলায় আসছিলাইন, সেই বছর সাথে কইরা দুইডা ছাগলও আনছিলেন।
শহুর আলী --- আর নোয়াখাইল্লেয়ারা হেই ছাগলগুলো চুরি কইরা জবাই কইরা খায়া লাইছিন।
বখতিয়ার --- আরে না না! চুরি করে নাই। মিথ্যা কতা (কথা)। (চলবে)
(আলোচিত গল্পটি মো. মাহফুজুর রহমানের ‘রাজহংসী বধ’ গল্পের বই থেকে নেওয়া।)
লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী সরকারি কলেজ।